রক্তে ভেজা বর্ণমালা।
সময়টা ১৯৪৮ সাল।
'আব্বু! আব্বু! আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও! আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না আব্বু। আমাকে নিয়ে যাও আব্বু!'
ঘুমের মধ্যে কথাগুলো বলেই কাঁদতে শুরু করে মিতা। আজ তিনদিন হলো তার বাবা একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। বাবাকে অনেক ভালোবাসত সে। তাই কষ্টটা অনেক বেশিই পেয়েছে মেয়েটা।
তার বাবার মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। এইতো সেদিন, বাবাকে নিয়ে ওর খালা সাহানা বেগমের বাড়ি থেকে
বেড়িয়ে আসলো। কত জায়গাতে বাবাকে
নিয়ে ঘুরল। আর আজ বাবা নেই! কথাটা ভাবলেই মিতার অনেক কান্না পায়। এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে একমাত্র ওর বাবাই ছিল। জন্মের
সময়ই মা মারা যায়। বাবা অনেক কষ্ট করে তাকে বড় করে, কখনো মেয়ের গায়ে একটা ফুলের টোকাও লাগতে দেয়নি। দ্বিতীয় বার বিয়ে করেনি তার বাবা। কারণ সৎ মা এসে যদি মেয়েকে কষ্ট
দেয়, অত্যাচার করে, সে কথা ভেবে।
.
'মিতা, কাঁদিস না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কত কাঁদবি মা। একটু ধৈর্য ধর মা, সব।ঠিক হয়ে যাবে। নামাজ পড়ে আল্লাহর
কাছে দোয়া কর আল্লাহ যেন তোর
বাবাকে
অনেক সুখে রাখে। তুই আর কাঁদিস না মা!' মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন সাহানা খালা।
'খালামনি, তুমি আমার আব্বুকে আমার
কাছে এনে দিতে পারবে? আমি তোমাকে আমার সব কবিতা, গল্পের বই দিয়ে দেবো। আমার সব কিছু দিয়ে দেবো।
তুমি শুধু আমার বাবাকে ফিরিয়ে এনে দাও। আব্বু তুমি এখন কী করছো আব্বু? খেয়েছে
আব্বু? হে আল্লাহ, তুমি কেন আমার কাছ থেকে আমার আব্বুকে কেড়ে নিলে। আমি কী অন্যায় করেছিলাম আল্লাহ!' এবার আরও জোরে জোরে কান্না করে মিতা।
.
মিতার খালা কী বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছেন না। মিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন, মেয়েটার কান্না সহ্য করতে না পেরে নীরবে নিজেও কেঁদে
ফেলেন।
.
এখন রাত দুটো বাজে। মিতাকে ঘরে শুইয়ে
দিয়ে মিতার খালা বাইরে গিয়েছিল এক জগ পানি আনতে, বড্ড পিপাসা
পেয়েছিল। ঘরে এসেই দেখে মিতা দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁদছে। সবকিছু কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেছে মিতার। কালকেই
মিতাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে মিতার
খালা।
.
এই দুনিয়ায় বর্তমানে আপন বলতে মিতার খালাই
আছেন। এক সন্তানকে নিয়ে তিনি ঢাকায় নিজস্ব
বাসাতে থাকেন। খালু
আজ পাঁচ বছর ধরে বিদেশে আছেন। তাঁর একমাত্র ছেলে মহিন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অনার্স
প্রথম বর্ষ, বাংলায়। পরীক্ষা থাকায়
মহিন ওর খালুকে শেষ
বারের মতো দেখতে যেতে পারেনি। খুব ভালো একটা ছেলে। পড়াশুনা, কবিতা, গল্প, গান, খেলাধুলা সবদিক থেকেই পারদর্শী। সবকিছুতেই তাঁর জুড়ি মেলা
ভার।
.
ইদানীং মহিনের মনটা ভালো নেই। একদিকে
খালুর এভাবে মারা যাওয়া, অন্যদিকে মিতার কথা ভেবে ওর খুব খারাপ লাগে।
.
'মিতা, ওঠ মা! সকাল হয়ে গেছে। রেডি হয়ে নে। নইলে ট্রেন মিস করব।' খালা তাড়া দিলেন।
মিতার মনটা একদম
ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কিছুই
ভালো লাগছে না মিতার। বাবার ভিটে মাটি
ছেড়ে চলে যেতে হবে। আবারও কান্না
করে মিতা। সাহানা বেগম এক প্রকার জোরপূর্বক মিতাকে খাইয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসে। এখন স্টেশনে ট্রেনের
জন্য অপেক্ষা করছে। একটু পরেই ট্রেন আসবে। তারপর সোজা ঢাকা। মিতা বাড়ি থেকে
আসার সময় বাবার শেষ স্মৃতি হিসেবে
বাবার একটা বড় ছবি নিয়ে আসে। এখনো
তাঁর বাবার ছবির ওপর হাত বুলাচ্ছে আর দুচোখ অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে। সাহানা বেগম ব্যর্থ সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।
.
বাসায় চলে আসে সাহানা বেগম
মিতাকে নিয়ে। মিতা আগেও অনেকবার এসেছে খালামনির বাসাতে ওর বাবার সাথে। বাবাকে খুব মিস করছে মেয়েটা। মিতাকে ওর খালার রুমেই থাকতে বলে। সে তার খালার রুমে গিয়ে বসে আছে।
.
মহিনের পরীক্ষা শেষ। ফলে আগামী কিছুদিন ছুটি।
'তোর পরীক্ষা শেষ বাবা?' সাহানা বেগম ছেলেকে জিজ্ঞেস করে। মহিন উত্তর দেয়, 'হ্যাঁ, মা।'
'বেশ ভালো। মিতা
একদম মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে রে। তুই বিকেলে মেয়েটাকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে
আয়। ওর মনটা একটু ভালো হবে।'
'ঠিক আছে আম্মু। আমি বিকেলে মিতাকে নিয়ে ঘুরতে যাব।'
.
মায়ের কথামতো মহিন বিকেলে বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এদিকে মিতা যাবে না, তবুও ওর খালার
জোর করাতে রাজি হয়ে যায়।
.
'আম্মু গেলাম তাহলে।'
'সাবধানে যাস বাবা। মিতাকে আঘাত দিয়ে কথা বলিস না যেন!'
'ঠিক আছে আম্মু। তুমি চিন্তা কোরো না।'
.
মহিন এই প্রথম কোনো মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে। মিতার জন্য ওর খুব মায়া হয়।
মা বাবা হারানো অনেক কষ্টের সেটা
মহিন ভালো করেই বুঝতে জানে।
.
'ভাইয়া, আমরা কোথায় যাচ্ছি?'
'পার্কে যাচ্ছি, মিতা।'
'আচ্ছা ভাইয়া, আপনি আমার বাবাকে আমার কাছে এনে দিতে পারবেন? বাবার
কাছে অনেক প্রশ্ন আছে আমার।'
'না মিতা, এটা সম্ভব না। তোমার বাবা অনেক ভালো আছে। তুমি কষ্ট পেয়ো না।
সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে মিতা। একদিন তো সবাইকেই এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। কেউ দুদিন আগে যাবে, কেউ
দুদিন পরে যাবে। এটাই দুনিয়ার নিয়ম।'
.
মহিন মিতাকে নিয়ে পার্কে পৌঁছে যায়। মিতাকে নিয়ে ঘুরে। চারিদিকটা অনেক সুন্দর। মেয়েটা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। আজকের বিকেলটা অনেক সুন্দর। মহিন
মিতাকে অনেক হাসানোর চেষ্টা করছে, অনেক রকম কৌতুক শুনাচ্ছে। মিতা প্রথমে না হাসতে চাইলেও কি রেহাই আছে! এমন কৌতুক না হেসে পারাই যাবে না।
মহিন এবার নিজেও হেসে ফেলে মিতার হাসি দেখে। বাহ্ কী অপরূপ মিতার হাসি! যেন স্বর্গের পরী হাসছে!
.
সেই থেকে স্কুল পড়ুয়া মিতার প্রতি ভালো লাগা শুরু হয় মহিনের। আস্তে আস্তে চারিদিকের আলো কমে
সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। মহিন আজকের বেড়ানো এখানেই শেষ করে বাসায় চলে এলো।
.
মহিনের জীবনের সবচেয়ে সেরা বিকেল ছিল আজকে। যেটা সে কখনোই ভুলতে পারবে না। স্মৃতির পাতায় রঙিন সুতো দিয়ে গেঁথে রাখবে।
.
সাহানা বেগম মিতাকে দেখে একটু প্রশান্তি পেল। মেয়ের মুখে হাসির ছাপ পেলো। মিতাকে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলল সাহানা বেগম।
.
রাতে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে।
.
তারপর মিতাকে ঢাকায় একটা স্কুলে দশম শ্রেণিতেই ভর্তি করে দেওয়া হয়। মিতা এখন ঠিকমতো স্কুলে
যাই, ঠিকমতো পড়াশুনা করে। মহিন ওকে পড়াশোনায় সাহায্য করে। মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে ঘুরতে যাই। গল্প করে, আড্ডা দেয়, সবকিছুই ভালোভাবেই চলছে।
.
আজ তিন বছর হলো মিতা এবং মহিনের
সম্পর্কের। মিতা কলেজ পাস করে এখন ইংরেজিতে অর্নাস করছে। আর মহিন চতুর্থ বর্ষে। মিতা ও মহিনের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক টের পায়
সাহানা বেগম। তিনি মনে মনে ঠিক করেন মহিনের বাবা বিদেশ থেকে কিছুদিন পরে বাসায় আসবে তখন এদের দুজনের বিয়ে
দেবেন।
.
মহিন মাসখানেক ধরে বাসায় থাকছে না। মিতার এবং সাহানা বেগমের মন খারাপ
অনেক। তবুও মহিন আসতে পারে না। দেশকে নিয়ে খুব চিন্তিত মহিন। দিন দিন দেশের অবস্থা খারাপ হতে লাগল। পাকিস্থানের গর্ভনর জেনারেল
মি. জিন্নাহ ১৯৪৮ ঢাকায় এসে রমনা রেসকোর্সের মাঠে ঘোষণা দিয়েছিল, পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু।
এ ঘোষণার পর থেকেই এখনো পর্যন্ত পুরো দেশ উত্তাল। দীর্ঘ সময় ধরে চলছে বাঙালিদের আন্দোলন। সবচেয়ে বেশি ক্ষেপে আছে বাংলাদেশি ছাত্র জনতা। মহিন ও তার বন্ধুরা এ ঘোষণা কিছুতেই মানে না। নিজের মাতৃভাষা, মায়ের বুলি বাংলা বাদ দিয়ে ওরা কিছুতেই উর্দুকে স্থান দেবে না। গায়ের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত বাংলা ভাষার জন্য লড়ে যাবে বলে শপথ করে ওরা।
.
সময় চলতে থাকে।
মহিনের বাবা দেশে ফিরেছেন। বাবাকে দেখতে শুধু একবার বাড়িতে এসেছিল মহিন।
এখন ১৯৫২ সাল ফেব্রুয়ারি মাস চলছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে পুরো দেশ উত্তাল। প্রায় প্রতিদিন মিটিং মিছিল হচ্ছে।
.
২১ ফেব্রুয়ারির দিন পাকিস্থানি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে দেয়, আন্দোলন ঠেকাতে। এতে ছাত্রসমাজ আরো বেশি ক্ষিপ্ত
হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ
সিন্ধান্ত নেয় ১৪৪ ধারা ভেঙে তারা এগোবে।
মহিনসহ তার সকল বন্ধু মিছিলে অংশ নেয়। সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
সকল ছাত্ররা ১৪৪ধারা ভঙ্গ মিছিল বের
করে। সবার হাতে পোস্টার, সবার মুখে একই স্লোগান। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই! রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।' কিন্তু বেশি দূর এগোতে না, পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। পুলিশের ছিল বন্দুক, বেয়নেট, টিয়ারগ্যাস ও
লাঠিসোঁটা। নিরস্ত্র ছাত্ররা ঝাপিয়ে পড়ে মায়ের ভাষার অধিকার আদায় করতে। সরকারি নির্দেশে পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরু হয়। একটা বুলেট এসে মহিনের বুকে লাগে। চোখের সামনে যেন বাংলা বর্ণমালা। মায়ের ভাষা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তার মাঝে চোখের সামনে দেখতে পায়
মিতার মুখ, মায়ের মুখ, বাবার মুখ, নিজের সাজানো স্বপ্ন। তবুও আজ আর কিছু করার নেই মহিনের। সব স্বপ্নের বুকে রক্ত ঢেলে মহিন সেখানেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে
পরে। আর কখনো ফিরবে না মহিম মিতার
স্বপ্নের রাজকুমার হয়ে। ফিরবে না কখনো
মা-বাবার বুকে।
চারিদিক নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে যায়।
.
বাসায় খবর যায় অনেক পরে। সরকার কর্তৃক গুম হওয়া লাশের মধ্যে মহিনেরটাও হারিয়ে যায়। একে তো ছেলে হারা, তার উপর ছেলের লাশটা পর্যন্তও না পেয়ে শোকে বিমূঢ় পাথর হয়ে যায় ওর বাবা। মহিনের মায়ের কান্না মেশানো আহাজারিতে বর্ণমালাগুলো হাহাকার করে উঠে। মিতা মেয়েটা, জীবনে আর সুখ দেখতে পেলো না। অবশ্য মিতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ছাড়াও এক ধরনের সুখানুভূতি ফুটে উঠছে। তার প্রিয় মানুষটা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে অমর হয়েছে। তার এটা ভেবে ভালো লাগছে, যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, বাংলার প্রতিটি বর্ণমালার সাথে জড়িয়ে থাকবে মহিনের রক্ত। সকল ভাষা শহিদদের কথা ভেবে মিতার চোখে একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত চাহনি ভেসে উঠে। চোখগুলো যেন সশব্দে বলছে,
'তোমরা মরোনি প্রিয়। তোমরা বেঁচে আছো বাংলা ভাষার অন্তঃস্থলে। সকল শিকল থেকে মুক্ত হোক মায়ের ভাষা। বেঁচে থাকুক অগণিত মানুষের মুখে বুলিতে!’
(সমাপ্ত)
-
'আব্বু! আব্বু! আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও! আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না আব্বু। আমাকে নিয়ে যাও আব্বু!'
ঘুমের মধ্যে কথাগুলো বলেই কাঁদতে শুরু করে মিতা। আজ তিনদিন হলো তার বাবা একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। বাবাকে অনেক ভালোবাসত সে। তাই কষ্টটা অনেক বেশিই পেয়েছে মেয়েটা।
তার বাবার মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। এইতো সেদিন, বাবাকে নিয়ে ওর খালা সাহানা বেগমের বাড়ি থেকে
বেড়িয়ে আসলো। কত জায়গাতে বাবাকে
নিয়ে ঘুরল। আর আজ বাবা নেই! কথাটা ভাবলেই মিতার অনেক কান্না পায়। এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে একমাত্র ওর বাবাই ছিল। জন্মের
সময়ই মা মারা যায়। বাবা অনেক কষ্ট করে তাকে বড় করে, কখনো মেয়ের গায়ে একটা ফুলের টোকাও লাগতে দেয়নি। দ্বিতীয় বার বিয়ে করেনি তার বাবা। কারণ সৎ মা এসে যদি মেয়েকে কষ্ট
দেয়, অত্যাচার করে, সে কথা ভেবে।
.
'মিতা, কাঁদিস না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কত কাঁদবি মা। একটু ধৈর্য ধর মা, সব।ঠিক হয়ে যাবে। নামাজ পড়ে আল্লাহর
কাছে দোয়া কর আল্লাহ যেন তোর
বাবাকে
অনেক সুখে রাখে। তুই আর কাঁদিস না মা!' মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন সাহানা খালা।
'খালামনি, তুমি আমার আব্বুকে আমার
কাছে এনে দিতে পারবে? আমি তোমাকে আমার সব কবিতা, গল্পের বই দিয়ে দেবো। আমার সব কিছু দিয়ে দেবো।
তুমি শুধু আমার বাবাকে ফিরিয়ে এনে দাও। আব্বু তুমি এখন কী করছো আব্বু? খেয়েছে
আব্বু? হে আল্লাহ, তুমি কেন আমার কাছ থেকে আমার আব্বুকে কেড়ে নিলে। আমি কী অন্যায় করেছিলাম আল্লাহ!' এবার আরও জোরে জোরে কান্না করে মিতা।
.
মিতার খালা কী বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছেন না। মিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন, মেয়েটার কান্না সহ্য করতে না পেরে নীরবে নিজেও কেঁদে
ফেলেন।
.
এখন রাত দুটো বাজে। মিতাকে ঘরে শুইয়ে
দিয়ে মিতার খালা বাইরে গিয়েছিল এক জগ পানি আনতে, বড্ড পিপাসা
পেয়েছিল। ঘরে এসেই দেখে মিতা দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁদছে। সবকিছু কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেছে মিতার। কালকেই
মিতাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে মিতার
খালা।
.
এই দুনিয়ায় বর্তমানে আপন বলতে মিতার খালাই
আছেন। এক সন্তানকে নিয়ে তিনি ঢাকায় নিজস্ব
বাসাতে থাকেন। খালু
আজ পাঁচ বছর ধরে বিদেশে আছেন। তাঁর একমাত্র ছেলে মহিন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অনার্স
প্রথম বর্ষ, বাংলায়। পরীক্ষা থাকায়
মহিন ওর খালুকে শেষ
বারের মতো দেখতে যেতে পারেনি। খুব ভালো একটা ছেলে। পড়াশুনা, কবিতা, গল্প, গান, খেলাধুলা সবদিক থেকেই পারদর্শী। সবকিছুতেই তাঁর জুড়ি মেলা
ভার।
.
ইদানীং মহিনের মনটা ভালো নেই। একদিকে
খালুর এভাবে মারা যাওয়া, অন্যদিকে মিতার কথা ভেবে ওর খুব খারাপ লাগে।
.
'মিতা, ওঠ মা! সকাল হয়ে গেছে। রেডি হয়ে নে। নইলে ট্রেন মিস করব।' খালা তাড়া দিলেন।
মিতার মনটা একদম
ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কিছুই
ভালো লাগছে না মিতার। বাবার ভিটে মাটি
ছেড়ে চলে যেতে হবে। আবারও কান্না
করে মিতা। সাহানা বেগম এক প্রকার জোরপূর্বক মিতাকে খাইয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসে। এখন স্টেশনে ট্রেনের
জন্য অপেক্ষা করছে। একটু পরেই ট্রেন আসবে। তারপর সোজা ঢাকা। মিতা বাড়ি থেকে
আসার সময় বাবার শেষ স্মৃতি হিসেবে
বাবার একটা বড় ছবি নিয়ে আসে। এখনো
তাঁর বাবার ছবির ওপর হাত বুলাচ্ছে আর দুচোখ অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে। সাহানা বেগম ব্যর্থ সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।
.
বাসায় চলে আসে সাহানা বেগম
মিতাকে নিয়ে। মিতা আগেও অনেকবার এসেছে খালামনির বাসাতে ওর বাবার সাথে। বাবাকে খুব মিস করছে মেয়েটা। মিতাকে ওর খালার রুমেই থাকতে বলে। সে তার খালার রুমে গিয়ে বসে আছে।
.
মহিনের পরীক্ষা শেষ। ফলে আগামী কিছুদিন ছুটি।
'তোর পরীক্ষা শেষ বাবা?' সাহানা বেগম ছেলেকে জিজ্ঞেস করে। মহিন উত্তর দেয়, 'হ্যাঁ, মা।'
'বেশ ভালো। মিতা
একদম মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে রে। তুই বিকেলে মেয়েটাকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে
আয়। ওর মনটা একটু ভালো হবে।'
'ঠিক আছে আম্মু। আমি বিকেলে মিতাকে নিয়ে ঘুরতে যাব।'
.
মায়ের কথামতো মহিন বিকেলে বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এদিকে মিতা যাবে না, তবুও ওর খালার
জোর করাতে রাজি হয়ে যায়।
.
'আম্মু গেলাম তাহলে।'
'সাবধানে যাস বাবা। মিতাকে আঘাত দিয়ে কথা বলিস না যেন!'
'ঠিক আছে আম্মু। তুমি চিন্তা কোরো না।'
.
মহিন এই প্রথম কোনো মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে। মিতার জন্য ওর খুব মায়া হয়।
মা বাবা হারানো অনেক কষ্টের সেটা
মহিন ভালো করেই বুঝতে জানে।
.
'ভাইয়া, আমরা কোথায় যাচ্ছি?'
'পার্কে যাচ্ছি, মিতা।'
'আচ্ছা ভাইয়া, আপনি আমার বাবাকে আমার কাছে এনে দিতে পারবেন? বাবার
কাছে অনেক প্রশ্ন আছে আমার।'
'না মিতা, এটা সম্ভব না। তোমার বাবা অনেক ভালো আছে। তুমি কষ্ট পেয়ো না।
সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে মিতা। একদিন তো সবাইকেই এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। কেউ দুদিন আগে যাবে, কেউ
দুদিন পরে যাবে। এটাই দুনিয়ার নিয়ম।'
.
মহিন মিতাকে নিয়ে পার্কে পৌঁছে যায়। মিতাকে নিয়ে ঘুরে। চারিদিকটা অনেক সুন্দর। মেয়েটা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। আজকের বিকেলটা অনেক সুন্দর। মহিন
মিতাকে অনেক হাসানোর চেষ্টা করছে, অনেক রকম কৌতুক শুনাচ্ছে। মিতা প্রথমে না হাসতে চাইলেও কি রেহাই আছে! এমন কৌতুক না হেসে পারাই যাবে না।
মহিন এবার নিজেও হেসে ফেলে মিতার হাসি দেখে। বাহ্ কী অপরূপ মিতার হাসি! যেন স্বর্গের পরী হাসছে!
.
সেই থেকে স্কুল পড়ুয়া মিতার প্রতি ভালো লাগা শুরু হয় মহিনের। আস্তে আস্তে চারিদিকের আলো কমে
সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। মহিন আজকের বেড়ানো এখানেই শেষ করে বাসায় চলে এলো।
.
মহিনের জীবনের সবচেয়ে সেরা বিকেল ছিল আজকে। যেটা সে কখনোই ভুলতে পারবে না। স্মৃতির পাতায় রঙিন সুতো দিয়ে গেঁথে রাখবে।
.
সাহানা বেগম মিতাকে দেখে একটু প্রশান্তি পেল। মেয়ের মুখে হাসির ছাপ পেলো। মিতাকে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলল সাহানা বেগম।
.
রাতে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে।
.
তারপর মিতাকে ঢাকায় একটা স্কুলে দশম শ্রেণিতেই ভর্তি করে দেওয়া হয়। মিতা এখন ঠিকমতো স্কুলে
যাই, ঠিকমতো পড়াশুনা করে। মহিন ওকে পড়াশোনায় সাহায্য করে। মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে ঘুরতে যাই। গল্প করে, আড্ডা দেয়, সবকিছুই ভালোভাবেই চলছে।
.
আজ তিন বছর হলো মিতা এবং মহিনের
সম্পর্কের। মিতা কলেজ পাস করে এখন ইংরেজিতে অর্নাস করছে। আর মহিন চতুর্থ বর্ষে। মিতা ও মহিনের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক টের পায়
সাহানা বেগম। তিনি মনে মনে ঠিক করেন মহিনের বাবা বিদেশ থেকে কিছুদিন পরে বাসায় আসবে তখন এদের দুজনের বিয়ে
দেবেন।
.
মহিন মাসখানেক ধরে বাসায় থাকছে না। মিতার এবং সাহানা বেগমের মন খারাপ
অনেক। তবুও মহিন আসতে পারে না। দেশকে নিয়ে খুব চিন্তিত মহিন। দিন দিন দেশের অবস্থা খারাপ হতে লাগল। পাকিস্থানের গর্ভনর জেনারেল
মি. জিন্নাহ ১৯৪৮ ঢাকায় এসে রমনা রেসকোর্সের মাঠে ঘোষণা দিয়েছিল, পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু।
এ ঘোষণার পর থেকেই এখনো পর্যন্ত পুরো দেশ উত্তাল। দীর্ঘ সময় ধরে চলছে বাঙালিদের আন্দোলন। সবচেয়ে বেশি ক্ষেপে আছে বাংলাদেশি ছাত্র জনতা। মহিন ও তার বন্ধুরা এ ঘোষণা কিছুতেই মানে না। নিজের মাতৃভাষা, মায়ের বুলি বাংলা বাদ দিয়ে ওরা কিছুতেই উর্দুকে স্থান দেবে না। গায়ের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত বাংলা ভাষার জন্য লড়ে যাবে বলে শপথ করে ওরা।
.
সময় চলতে থাকে।
মহিনের বাবা দেশে ফিরেছেন। বাবাকে দেখতে শুধু একবার বাড়িতে এসেছিল মহিন।
এখন ১৯৫২ সাল ফেব্রুয়ারি মাস চলছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে পুরো দেশ উত্তাল। প্রায় প্রতিদিন মিটিং মিছিল হচ্ছে।
.
২১ ফেব্রুয়ারির দিন পাকিস্থানি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে দেয়, আন্দোলন ঠেকাতে। এতে ছাত্রসমাজ আরো বেশি ক্ষিপ্ত
হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ
সিন্ধান্ত নেয় ১৪৪ ধারা ভেঙে তারা এগোবে।
মহিনসহ তার সকল বন্ধু মিছিলে অংশ নেয়। সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
সকল ছাত্ররা ১৪৪ধারা ভঙ্গ মিছিল বের
করে। সবার হাতে পোস্টার, সবার মুখে একই স্লোগান। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই! রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।' কিন্তু বেশি দূর এগোতে না, পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। পুলিশের ছিল বন্দুক, বেয়নেট, টিয়ারগ্যাস ও
লাঠিসোঁটা। নিরস্ত্র ছাত্ররা ঝাপিয়ে পড়ে মায়ের ভাষার অধিকার আদায় করতে। সরকারি নির্দেশে পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরু হয়। একটা বুলেট এসে মহিনের বুকে লাগে। চোখের সামনে যেন বাংলা বর্ণমালা। মায়ের ভাষা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তার মাঝে চোখের সামনে দেখতে পায়
মিতার মুখ, মায়ের মুখ, বাবার মুখ, নিজের সাজানো স্বপ্ন। তবুও আজ আর কিছু করার নেই মহিনের। সব স্বপ্নের বুকে রক্ত ঢেলে মহিন সেখানেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে
পরে। আর কখনো ফিরবে না মহিম মিতার
স্বপ্নের রাজকুমার হয়ে। ফিরবে না কখনো
মা-বাবার বুকে।
চারিদিক নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে যায়।
.
বাসায় খবর যায় অনেক পরে। সরকার কর্তৃক গুম হওয়া লাশের মধ্যে মহিনেরটাও হারিয়ে যায়। একে তো ছেলে হারা, তার উপর ছেলের লাশটা পর্যন্তও না পেয়ে শোকে বিমূঢ় পাথর হয়ে যায় ওর বাবা। মহিনের মায়ের কান্না মেশানো আহাজারিতে বর্ণমালাগুলো হাহাকার করে উঠে। মিতা মেয়েটা, জীবনে আর সুখ দেখতে পেলো না। অবশ্য মিতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ছাড়াও এক ধরনের সুখানুভূতি ফুটে উঠছে। তার প্রিয় মানুষটা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে অমর হয়েছে। তার এটা ভেবে ভালো লাগছে, যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, বাংলার প্রতিটি বর্ণমালার সাথে জড়িয়ে থাকবে মহিনের রক্ত। সকল ভাষা শহিদদের কথা ভেবে মিতার চোখে একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত চাহনি ভেসে উঠে। চোখগুলো যেন সশব্দে বলছে,
'তোমরা মরোনি প্রিয়। তোমরা বেঁচে আছো বাংলা ভাষার অন্তঃস্থলে। সকল শিকল থেকে মুক্ত হোক মায়ের ভাষা। বেঁচে থাকুক অগণিত মানুষের মুখে বুলিতে!’
(সমাপ্ত)
![]() |
শহীদ মিনার |
-
No comments
Post a Comment