বৃষ্টিমা
বৃষ্টিমা
শ্রাবণ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে কিছু বলছে না। আমি পিছনের সিটে বসে আছি। বাইরে তুমুল ঝড়। সামনে কিছু ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। জানালার কাচে বারবার কিছু বারি খাচ্ছে। আমার চশমার গ্লাস ও ঝাপসা হয়ে আসছে মনে হয়। শ্রাবণ বলেছিলো কাল সকালে যেতে। আমিই জোর করলাম এখন নিয়ে আসার জন্য।
পানির পিপাসা লাগায় পানি আনতে ডাইনিং এ যেতেই বৌ'মার চিল্লাচিল্লি শুনলাম।
-তুমি এখনো তোমার মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছো না কেন?
-বললাম তো কাল সকালে দিয়ে আসবো।
-আরো একটা রাত কি দরকার এমন জঞ্জাল সহ্য করার!
এইসব কথা যে নতুন শুনছি এমন নয়। কিন্তু সেদিন হয়তো সহ্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিলো। তার উপর সকাল বেলা শ্রাবণ এসে বলেছিলো
-মা একটা কথা বলবো?
-বলনা, কি বলবি?
Helvetica, Arial, sans-serif; font-size: 14px;">-আসলে মা তোমার বয়স হয়েছে। আমি আর সিনথিয়া দু'জন ই তো অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। তোমার দেখাশোনা করার প্রয়োজন আছে। তাই চাচ্ছিলাম তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো। শুধুমাত্র তোমার যত্নের জন্য ই। ভালো না লাগলে তুমি শুধু আমায় একবার বলবে আমি তোমায় আবার নিয়ে আসবো।
এরকম কিছু শোনার জন্য আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। তাই একটা ম্লান হাসি দিয়ে বলেছিলাম
-পাগল ছেলে, তুই যা ভালো মনে করিস তাই হবে।
।
।
আমি যখন ডাইনিং এ পানি আনতে গিয়েছিলাম তখন ই ওদের কথা কানে এসেছিলো। আর হাত থেকে জগটা পড়ে ভেঙে যায়। বৌ মা এসে চিল্লাচিল্লি শুরু করে
-আছে শুধু নষ্ট করার ধান্দায়। জিনিসপত্র কিনতে কত খরচ যায় সেই হিসেব আছে?
আমি শুধু ছেলেকে নিচুস্বরে বলেছিলাম
-বাবা বয়স হয়েছে তো। চোখে দেখি না ঠিকমতো। তুই না আমায় কোথায় নিয়ে যাবি? এখনি নিয়ে যা।
আমার কথা শুনে বৌ'মার চোখ মুখ উজ্জ্ল হয়ে উঠে। শ্রাবণ কিছু বলার আগে নিজেই বলে উঠে "আমি এক্ষুণি আপনার লাগেজ গুছিয়ে দিচ্ছি"
কিছুক্ষণের মধ্যেই লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে আসে। আর আমরা বের হয়ে যাই। আসার আগে বারবার ফিরে শেষবারের মতো বাড়ি, বাড়ির আঙিনা দু'চোখ ভরে দেখে নিয়েছি।
।
।
গাড়ি চলছিলো সাথে আমার চোখের সামনে পুরোনো স্মৃতিগুলি। তখন আমি মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। আর দুইমাস পর ই এখানের পড়ালেখা কে বিদায় জানিয়ে ডাক্তার হওয়ার কথা। ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছি। খুব জোর বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাত্ আমাদের পিয়ন রহমত মিয়া এসে বললো তার মেয়ে রহিমা আপুর নাকি প্রসব বেদনা উঠেছে কিন্তু এই মূহূর্তে কোনো গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। অবস্থা খুব খারাপ। ব্লিডিং ও শুরু হয়ে গেছে। আমাকে ডেলেভারির কথা বললো কিন্তু অপক্ক হাতে আমি এটা করতে চাইছিলাম না। তার উপর আমি এই বিভাগের ছাত্রী ও না। তবে শখের বসে একটা চাপটার পড়েছিলাম লাইব্রেরি তে। সেই হিসেবে কিঞ্চিত্ জ্ঞান ছিলো। কিন্তু সেই জ্ঞানে এতো রিস্ক নেওয়া! কোনো মতেই মন সায় দিচ্ছিলো না। রহিমা আপুর কথা ভেবে তবু গিয়েছিলাম। এতো পরিমাণ ব্লিডিং দেখে আমি কি থেকে কি করবো এই ভেবেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। অবশেষে যতটুকু জ্ঞান ছিলো তা প্রয়োগ করে বাচ্চাটা বাঁচাতে পারলেও আপুকে বাঁচাতে পারি নি।
রহমত চাচাকে খবর টা দিতেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললেন
-মেয়েটার কপালে সুখ ছিলো না। চলে গেছে ভালোই হইছে। যৌতুকের টাকার জন্য তো শ্বশুর বাড়ি টিকতে পারলো না। কত অত্যাচার ই না সহ্য করেছে। এখন একটু শান্তিতে ঘুমাক। তুমি বাচ্চাটা কোনো এতিমখানায় রেখে এসো। নয়তো ড্রেনে ফেলে দিও।
এই বলে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন। আমি কি করবো ভেবে না পেয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
।
।
বেশ কিছু এতিমখানায় ওকে নিয়ে গেলাম কিন্তু কেউ ই এতো ছোট বাচ্চাকে রাখতে রাজি নয়। ড্রেনে ফেলতে গিয়ে হৃদয় কেঁপে উঠলো। নিয়ে গেলাম বাসায়। বাবা-মা কোনো মতেই আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিলেন না। অনেক বুঝিয়ে যখন বললাম বাচ্চাটা বসতে শিখলে কোনো এতিমখানায় দিয়ে আসবো। অবশেষে আমার জেদের কাছে হার মানতে রাজি হয়। আমার ডাক্তারি পড়া শেষ হয় আর বাচ্চাটা ও আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। শ্রাবণ মাসে হয়েছিলো বলে নাম রেখেছিলাম শ্রাবণ। শ্রাবণের প্রতি একটা মায়া জন্মে যায়। বিশেষ করে যখন মা ডাক শুনেছিলাম ওর মুখে। মাতৃত্বের এতো আনন্দ তা জানতাম ই না।
তখন তৌহিদ নামে এক ছেলের সাথেও আমার দীর্ঘদিনের প্রণয় ছিলো। তৌহিদকে বলেছিলাম শ্রাবণকে সহ বিয়ে করার কথা। কিন্তু অন্যের সন্তানকে তৌহিদ মানতে নারাজ। শ্রাবণ কে ছাড়া সম্ভব ছিলো না বিধেয় তৌহিদের সাথে আমার সম্পর্ক টা ভেঙে যায়। বাবা-মা আমার জন্য কোনো সম্বন্ধ দেখতে পারছিলো না বলে দিনরাত সবসময় কথা শুনাতো। কানে নিতাম না।
ঘরে বাইরে সব জায়গায় কথা শুনতে হতো। কার পাপ বড় করছি। কার সাথে কি করে বেড়াইছি আরো কত অকথ্য কথাবার্তা। একদিন তো পাশের বাড়ির সেলিম ভাই বলেই ফেলছিলেন "আজকে রাতে আইসো। ভালো দাম দিবো নে"
কোনো প্রতিবাদ করতে পারি নি। শুধু মাথা নিচু করে চলে এসেছিলাম। তখন শ্রাবণের বছর তিন চলছিলো। এখন থেকেই ও সবকিছু মোটামুটি বুঝতে শিখা শুরু করবে। আমি চাচ্ছিলাম না ওর ছোট মন টা বিষিয়ে যাক। তাই মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ম্যারিজ সার্টিফিকেট, ডেলিভারি সার্টিফিকেট ও হাজবেন্ড এর ডেড সার্টিফিকেট সবকিছু ভুয়া বানিয়ে চিরচেনা শহর ছেড়ে চলে এসেছিলাম।
নতুন শহরে বাস্তবতার মুখোমুখি আরো বেশি হতে হয়েছিলো। কোথাও চাকরি পাচ্ছিলাম না। প্রথম কয়েকমাস মানুষের বাসায় কাজ করে রাস্তায় ইট ভেঙে সংসার চালিয়েছি। কত হায়নার নজর থেকে যে নিজেকে আগলিয়ে রাখতে হয়েছে তা বলার মতো না। অবশেষে একদিন একটা হাসপাতালে ডাক্তার এর চাকরি টা হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে প্রমোশন ও হয়।
যে আমার একসময় মাথার উপর ছাদ ছিলো না তার বাড়ি-গাড়ি সব ই হয়েছিলো। শুধু ঘরে বৌ নাতি-নাতনির অভাব ছিলো। ছেলেকে বিয়ের কথা বলাতে বললো পছন্দের মেয়ে আছে। ছেলের পছন্দ এর মেয়েকেই বিয়ে করিয়ে আনলাম।
সেই মেয়ে ই আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলো। এতে আমার কোনো আফসোস নেই। ছেলেটা সুখে থাকলেই হলো।
তবুও জানো কি মা কেনো যেনো একটা কষ্ট হয়। বৃষ্টি আসলে স্মৃতিগুলি তাড়া করে তাই আজ আশ্রম থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। জীবনের কাহিনির শুরু ও শেষ এমন একটা বৃষ্টির দিনেই করতে চেয়েছিলাম।``
।
।
আমি এতোক্ষণ উনার কথা স্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম। প্রথমে যখন উনি এসে আমার গাড়ির সামনে পড়লেন তখন খুব মেজাজ খারাপ হয়েছিলো।
কিছু একটা হয়ে গেলে তো এখন আমাকে জেলে যেতে হতো। কিন্তু উনার কথা শুনে এখন নিজেকে এই ভাবনার জন্য অপরাধী লাগছে।কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে উনার মুখ দেখে মনে হয়েছিলো অনেকদিন কিছু খায় না। তাই এই রেস্তারাঁয় বসা। আর মনে হচ্ছিলো উনার কিছু অপ্রিয় অতীত আছে। সেটা শোনার জন্য বহুত জোর করার পর বললেন। উনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছি মানুষ কেন এতো ভালো হয়? যেই ছেলে রাস্তার টোকাই হতো সে ছেলে আজ বড় বিজনেসম্যান। আর উনার বিয়ে হলে তো জীবন টা আরো সুন্দর হতে পারতো। এতো অবাক হয়েছিলাম যে উনি কথা বলার সময় বারবার ফুঁপিয়ে কাদছিলেন আমি চোখের পানি ও মুছার চেষ্টা করি নি। উনি এখনো কাঁদছে আমি অনেকক্ষণ নিরব হয়ে দেখছিলাম। তারপর বলে উঠলাম
-আপনি আমার সাথে আমার বাসায় যাবেন?
উনি খুব অবাক হলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন
-নারে পাগলি। সংসার জীবনে আর প্রবেশের ইচ্ছে নেই।
-মা কি মেয়ের সাথে থাকতে পারে না?
উনি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে নিয়ে তাকাতেই আমি আবার বলে উঠলাম
-এক বৃষ্টিতে তুমি তোমার ছেলেকে পেয়েছিলো। অন্য বৃষ্টিতে না হয় তোমার মেয়ে তোমাকে খুঁজে পেলো। যাবে আমার সাথে, "বৃষ্টিমা"?
-বৃষ্টিমা!
-হ্যাঁ মানুষের কত মা থাকে। সই মা, সৎ মা আরো কত কিছু! আর আমার থাকবে বৃষ্টিমা।
তখন ও উনি কাদছিলেন। কিন্তু আমি জানি এই কান্না সুখের কান্না। বৃষ্টিমাকে বাসায় নিতে নিতে ভাবছিলাম মা-বাবার রিএকশন কি হবে! কিন্তু তারা সব শুনে খুব খুশি হলেন আমার সিদ্ধান্তে। বাবা তো বলেই উঠলেন "I am proud of you my princess"
এখন আমার দুইটা মা। কি মজা! আদর ডাবল হয়ে গেছে। বৃষ্টিমা রাতে লুকিয়ে কাদে দেখছি। আমি জানি উনার সব কষ্ট দূর করার ক্ষমতা আমার নেই। ঐ নরপশুর কাছে উনাকে আমি দিয়ে আসবো না। আমার বৃষ্টিমা আমার কাছে থাকবে। আমি তার সব কষ্ট না ভুলাতে পারলেও নতুন কষ্ট পেতে দিবো না। বৃষ্টিমা এর আরেক জীবন না হয় আমার সাথেই আবার নতুন করে শুরু হলো!
No comments
Post a Comment